সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১৬ পূর্বাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল

প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন:
এক পাগল রাস্তার মাঝখানে শুয়ে ছিল। লোকজন এসে বললো, তুই যে এখানে শুয়ে আছিস। তোর ওপর দিয়ে তো গাড়ি চলে যাবে। তুই তো মরে যাবি। পাগল তাচ্ছিল্যভরে উত্তর দিল, ‘প্রতিদিন আমার ওপর দিয়ে কত বিমান চলে যায়। আমি মরি না। আর গাড়ি চলে গেলে মরে যাবো!’

তবে সেই পাগলের আত্মবিশ্বাস বোধহয় এখনকার বাংলাদেশে টিকবে না। বিমানচাপায় যেখানে গরু মারা যায়, সেখানে মানুষ তো কোন ছার। ‘বিমানের ধাক্কায় গরুর মৃত্যু’ পত্রিকায় এই শিরোনাম দেখে আমার প্রথম বিশ্বাসই হয়নি। এটা কীভাবে সম্ভব! বিমান ওঠানামার জন্য একটি নিরাপদ রানওয়ে আবশ্যিক শর্ত। বিশ্বের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ‘বার্ড শ্যুটার’ বলে একটা পদ আছে। বার্ড শ্যুটারদের কাজ হলো বিমান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে বিমানবন্দর এলাকার পাখি নিধন করা।

দেশে সবকিছুই চলছে উল্টাপাল্টা। এখন আর তাই কিছুতেই চমকানো যাবে না। বিমানের ধাক্কায় গরুর মৃত্যুর খবর আমাকে চমকিত করলেও আসলে চমকানো উচিত হয়নি। খবরটি পড়ে আমার খালি মনে হচ্ছিল- ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।

বিমানবন্দর এলাকায় পাখি যেখানে নিরাপদ নয়, সেখানে গরু কীভাবে নির্বিঘ্নে রানওয়েতে চড়তে পারে! এখন দেখছি সবই সম্ভব। এ যেন এক পাগলের কারখানা। বাংলাদেশের ৮টি বিমানবন্দরের মধ্যে ৩টি আন্তর্জাতিক, বাকি ৫টিতে অভ্যন্তরীণ বিমান ওঠানামা করে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ৩টি মোটামুটি নিরাপদ হলেও, অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের যেন কোরো মা বাপ নেই। নিরাপত্তা দেয়ালের কাঁটাতার কাটা, বিমানবন্দরের ভেতরে মানুষ ঘাষ কাটছে; এমন ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যে কক্সবাজার বিমানবন্দরে বিমানের ধাক্কায় গরুর মৃত্যু হয়েছে, সে বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে বিশাল প্রকল্প নেয়া হয়েছে। রানওয়ের একটা বড় অংশ থাকবে সমুদ্রের ভেতরে। তখন না জানি বিমানের ধাক্কায় তিমি বা ডলফিনের মৃত্যুর খবর পড়তে হয়!

বাংলাদেশ আসলে সব সম্ভবের দেশ। কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। আপনি রাস্তায় হাঁটতে যাবেন, ময়লার গাড়ি এসে আপনাকে চাপা দেবে। মোটর সাইকেল আপনাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত। শিক্ষার্থীরা অনেকদিন ধরে ক্লাশরুম ফেলে রাস্তায়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। কারো কোনো হেলদোল নেই। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে শুনিয়ে ক্লাশরুমে ফেরানোর বদলে সরকার ব্যস্ত আন্দোলনে বহিরাগত আর উসকানি খুঁজতে।

এ বছরের প্রথম ১১ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে শিক্ষার্থীই মারা গেছে ৭৩৭ জন। শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছে, সেই নভেম্বর মাসেও মারা গেছে ৫৪ জন। শিক্ষার্থীরা তো আন্দোলন করবেই। তাছাড়া শিক্ষার্থী হোক আর বহিরাগত; নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করার অধিকার তো সবারই আছে। এমন তো নয়, সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু শিক্ষার্থীরাই মারা যাচ্ছে।

সড়ক তো নিরাপদ করতে হবে সবার জন্য। তাই আন্দোলনটা শিক্ষার্থীরা শুরু করলেও সবারই অধিকার আছে সে আন্দোলনে শরিক হওয়ার। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিগুলো দ্রুত মেনে নেয়া। সড়ককে নিরাপদ করতে কার্যকর ব্যবস্থা। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশে ছাত্রদের হাফ ভাড়া নিশ্চিত করা। কিন্তু পত্রিকায় দেখছি, বিআরটিসিও হাফ ভাড়া পুরোপুরি নিশ্চিত করেনি।

কয়েকদিন আগে ডিজেলের দাম বাড়ার পর পরিবহন মালিকরা হুট করে বিনা ঘোষণায় সব যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। গোটা জাতিকে তিনদিন জিম্মি রাখার পর সরকার বানেসর ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। ডিজেলের দাম ২৩ ভাগ বাড়লেও ভাড়া বাড়ানো হয় ২৭ ভাগ। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি পরিবহন শ্রমিকরা।

এবার তারা বাস বন্ধ করে দেয়। কারণ সরকার ভাড়া বাড়িয়ে যা করেছে; সিটিং সার্ভিস, গেটলক ইত্যাদি বাহারি নামে আগে থেকেই এরচেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছিল। এখন সরকারের বাড়ানো ভাড়া ঠিকঠাকমত কার্যকর হলে অনেক বাসের ভাড়া কমে যাবে। তাই শ্রমিকরা মালিকদের কথা মানতে নারাজ। অনেক চেষ্টা করেও সিটিং সার্ভিস বন্ধ করা যায়নি। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য শুধু রাস্তায় নয়, সর্বত্রই বিরাজমান। কেউ কারো কথা শোনে না, মানে না।

শুধু পরিবহন খাত নয়, নৈরাজ্য আসলে দেশের সব খাতেই। আপনি ছোট চাকরিজীবী হলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে আপনার চৌদ্দগোষ্ঠির খবর নেবে। ঋণের কিস্তি জমা দিতে একটু দেরি হলেই ফোন করে পাগল করে দেবে আপনাকে। দেরি একটু বেশি হলে আপনার গ্যারান্টারসহ পরিচিত সবাইকে ফোন করবে। আপনার বাসায় বা অফিসে মাস্তান পাঠাবে। কিন্তু যারা শত কোটি, হাজার কোটি, লাখো কোটি ঋণ নিয়ে মেরে দেয়; তারা সমাজে ভিআইপি মর্যাদা পায়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে কোনো না কোনো সম্পদ জামানত হিসেবে রাখতে হয়। ব্যাংক যদি ঠিকমত খোঁজ নিয়ে, সঠিক মূল্যের সম্পদ জামানত হিসেবে রাখে, তাহলে তো ঋণ খেলাপী হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। খেলাপী হলে জামানত রাখা সম্পদ বিক্রি করেই ব্যাংক তার টাকা ফিরে পেতে পারে। কিন্তু আমরা বুঝি, জামানতের সম্পদের মূল্য ঠিকমত যাচাই না করেই ঋণ দেয়া হয়, যা আর কখনো ফিরে আসে না।

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও দেদার। টাকা পাচারের কথা সবাই জানে, পাচারকারীদের সবাই চেনে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেনই না। অর্থমন্ত্রী না জানলে আর সমস্যা কি। কোনোরকমে টাকা পাচার করতে পারলে আর চিন্তা নেই; কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় নিশ্চিন্ত জীবন।

এ দেশে এখন সবকিছু চলে উল্টোপথে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে মানুষকে ঠেলে দেয়া হলো শেয়ারবাজারের দিকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আর সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ঠেলাঠেলিতে শেয়ারবাজারে টালমাটাল অবস্থা। শেয়ারবাজারে বারবার নিঃস্ব হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। আর কিছু জুয়ারি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়।

দেশে সবকিছুই চলছে উল্টাপাল্টা। এখন আর তাই কিছুতেই চমকানো যাবে না। বিমানের ধাক্কায় গরুর মৃত্যুর খবর আমাকে চমকিত করলেও আসলে চমকানো উচিত হয়নি। খবরটি পড়ে আমার খালি মনে হচ্ছিল- ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।

৫ ডিসেম্বর, ২০২১

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION